ভারতের জলবায়ুর নিয়ন্ত্রক | Regulator of Climate in India

ভারতের জলবায়ুর নিয়ন্ত্রক

ভারতের-জলবায়ুর-নিয়ন্ত্রক
Photo by Neda Astani on Unsplash


    ভারত মূলত মৌসুমি জলবায়ুর দেশ। মৌসুমি জলবায়ুর দেশ হল ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকমের জলবায়ু লক্ষ করা যায়। ভারতের মত এত বৈচিত্র্য জলবায়ু পৃথিবীর খুব কম দেশেই দেখা যায়।

ভারতের এরকম বৈচিত্র্যপূর্ণ জলবায়ুর বিভিন্ন কারণ বর্তমানে।

আজকের এই পোষ্টে আলোচনা করা হবে, ভারতের জলবায়ু নিয়ন্ত্রক সম্পর্কে।


ভারতের জলবায়ুর নিয়ন্ত্রণকারী উপাদান:

অক্ষাংশ এবং অক্ষাংশগত বিস্তার:


ভারত এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত একটি দেশ। পূর্ব-পশ্চিম গোলার্ধ হিসেবে ভারত পূর্ব গোলার্ধে এবং উত্তর দক্ষিণ গোলার্ধের ভারত উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত।

দক্ষিণে ৮.৪° উত্তর অক্ষাংশ থেকে ভারতের বিস্তার ৩৭.৬° উত্তর অক্ষাংশ পর্যন্ত।

পশ্চিমে গুজরাটের গুহার মোতি (৬৮°৭') থেকে পূর্বে কিবিথু (৯৭°২৪') পর্যন্ত সুবিস্তৃত আমাদের দেশ।

ভারতের প্রায় মাঝখান দিয়ে গেছে কর্কটক্রান্তি রেখা।

তাই ভারতের দক্ষিণভাগ অর্থাৎ কর্কটক্রান্তি রেখার নিচের অংশ উষ্ণমন্ডলে এবং উত্তরভাগ অর্থাৎ কর্কটক্রান্তি রেখার উপরের অংশ উত্তর নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলে অবস্থিত।

তাই ভারতের দক্ষিণ দিকে সামান্য প্রশ্ন এবং উত্তর দিকে তদপেক্ষা শীতল জলবায়ু দেখা যায়।

 আবার উপদ্বীপীয় ভারত তিন দিক থেকেই জল দিয়ে ঘেরা। ফলতঃ ভারতের উপকূল অঞ্চলে সারাবছর ধরে সমভাবাপন্ন জলবায়ু (দিনরাত এবং গ্রীষ্ম ও শীতকালে এর মধ্যে তাপমাত্রার পার্থক্য খুব একটা বেশি হয় না) এবং মধ্যভাগে চরমভাবাপন্ন জলবায়ু দেখা যায়।


হিমালয় পর্বতের অবস্থান:


বিশেষ দ্রষ্টব্য: হিমালয় পর্বতের অবস্থান কিভাবে ভারতীয় জলবায়ুকে প্রভাবিত করে তা জানার জন্য এই পোষ্টটি অবশ্যই দেখুন -



ভারতের উত্তর দিকে হিমালয় পর্বতের দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে ভারতের জলবায়ুকে ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। হিমালয় পর্বত শীতের সময় মধ্য এশিয়া থেকে আগত হিম-শীতল বায়ু কে ভারতবর্ষে ঢুকতে বাধা দেয়।

আবার, গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ু কি মানে বাধা পেয়েই সারা ভারতে শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত সৃষ্টি করে।

এছাড়া ভারতের উত্তর দিকে অবস্থিত হিমালয় পর্বত ভারতের বেশকিছু রাজ্যে জুড়ে অবস্থান করে। এইসব জায়গাগুলি হিমালয় পর্বতমালার ওপর অবস্থিত হওয়ার অধিক উচ্চতার কারণে সারা বছরই এখানকার উষ্ণতা অনেক কম থাকে।


মৌসুমী বায়ুপ্রবাহ:


 ভারতের জলবায়ুর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রক মৌসুমী বায়ুপ্রবাহ। এই কারণেই ভারতকে মৌসুমী জলবায়ু দেশ বলা হয়। গ্রীষ্মকালে (এপ্রিল - মে) মাসে ভারত মহাসাগরে উচ্চচাপ কক্ষের সৃষ্টি হয় এবং অধিক উষ্ণতায় কারণে ভারতের মূল ভূখণ্ডের গভীর নিম্নচাপ কক্ষের সৃষ্টি হয়। এই কারণে অনুসারে ভারত মহাসাগর থেকে বায়ু ভারতের মূল ভূখণ্ডের দিকে প্রবাহিত হয়। দক্ষিণ দিক থেকে আসার সময় এই বায়ু ফেরেল - এর সূত্র অনুসারে পূর্ব দিকে বেশ খানিকটা বেঁকে প্রবাহিত হয়। (তাই এই বায়ুকে দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বলা হয়) এই বায়ু জলভাগের উপর দিয়ে আসার জন্য জলীয় বাষ্পপূর্ণ হয়। এই জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু ভারতের বিভিন্ন পর্বত যেমন পশ্চিমঘাট পর্বতমালা, হিমালয় পর্বতমালা তে বাঁধা পেয়ে পর্বতের প্রতিবাত ঢালে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। এভাবেই সারা ভারতে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত হয়।

আবার শীতকালে ভারতীয় ভূখণ্ডে কম উষ্ণতার জন্য উচ্চকক্ষ এবং ভারত মহাসাগরে বেশি উষ্ণতার কারণে নিম্নচাপ কক্ষ গড়ে ওঠে। এই কারণে শীতকালে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বায়ু ভারত মহাসাগরের দিকে প্রবাহিত হয়। ফেরেলের সূত্র অনুসারে এই বায়ু পশ্চিম দিকে বেশ খানিকটা বেঁকে প্রবাহিত হয়। (তাই এই বায়ুকে উত্তর পূর্ব মৌসুমি বায়ু বলা হয়।) এই বায়ু স্থলভাগের উপর দিয়ে আসার জন্য শুষ্ক হয়। এই শুষ্ক বায়ু শীতকালে সারাদেশে উষ্ণতা কমিয়ে দেয় (উচ্চ পার্বত্য অঞ্চল থেকে আসার জন্য) এবং আবহাওয়া তে শুষ্কতার সৃষ্টি করে। এছাড়াও, মৌসুমী বায়ু প্রবাহের কারণে সারা ভারতে বৃষ্টিপাতের অসম বন্টন এর সৃষ্টি হয়।

এভাবেই মৌসুমী বায়ুপ্রবাহ ভারতের জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করে।


সমুদ্র থেকে দূরত্ব:

কোনো স্থান সমুদ্রের যত কাছে অবস্থিত হবে, সেখানকার জলবায়ু তত সমভাবাপন্ন হবে। অর্থাৎ সেখানে দিনরাতের মধ্যে o গ্রীষ্ম ও শীত কালের মধ্যে তাপমাত্রার পার্থক্য তত কম হবে। তাই সমুদ্রের কাছে অবস্থিত অঞ্চলের জলবায়ু মনোরম প্রকৃতির হয়।

আবার,

কোনো স্থান সমুদ্রে  থেকে যত দূরে অবস্থিত হবে, সেখানকার জলবায়ু তত চরমভাবাপন্ন হবে। অর্থাৎ সেখানে দিনরাতের মধ্যে ও গ্রীষ্ম ও শীত কালের মধ্যে তাপমাত্রার পার্থক্য তত বেশি হবে। তাই সমুদ্রের কাছে অবস্থিত অঞ্চলের জলবায়ু প্রতিকূল প্রকৃতির হয়।

যেমন: রাজস্থান সমুদ্রের থেকে দূরে অবস্থিত হওয়ায়, এখানে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এর উপরেও চলে যায়।

আবার ভারতের উপকূল অঞ্চলের তাপমাত্রা সারা বছর ধরে মোটামুটি ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এর কাছাকাছি থাকে।


ভূপ্রকৃতি:

ট্রপোস্ফিয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে উষ্ণতা হ্রাস পায়। আমরা সবাই বায়ুমণ্ডলের ট্রপোস্ফিয়ারে বাস করায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা যত বৃদ্ধি পায় উষ্ণতা তত কমতে থাকে।

প্রতি ১০০০ মিটার উচ্চতা বৃদ্ধিতে উষ্ণতা ৬.৪°./৬.৫° সেন্টিগ্রেড হারে হ্রাস পায় (একে উষ্ণতা হ্রাসের স্বাভাবিক হার বলা হয়)। এ কারণে যে স্থান যত উঁচুতে অবস্থিত তার উষ্ণতা সাধারণভাবে ততোই কম হয়।

এজন্য, দার্জিলিং, গ্যাংটক, সিমলা, লাদাখ ইত্যাদি স্থানে উষ্ণতা সারা বছরই খুব কম থাকে। এমনকি কিছু কিছু স্থানে অধিক উচ্চতার কারণে শীতকালে বরফ পড়ে।


জেট বায়ু:

ভারতের জলবায়ুতে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব মৌসুমী বায়ুর, এটা আমরা আগেই জেনেছি। আবার এই মৌসুমী বায়ুপ্রবাহের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে জেট বায়ু প্রবাহ। এ কারণে জেট বায়ুও প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ভারতের জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করে।


প্রত্যক্ষভাবে জেট বায়ু কিভাবে আমাদের দেশের জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করে তা আমরা এখন জানবো,

গ্রীষ্মকালে তিব্বত মালভূমি উষ্ণ বাতাস ক্রান্তীয় পূবালী জেট বায়ু কে শক্তিশালী করে তোলে। পূবালী জেট এর প্রভাবে ভারতের মাঝখানে অর্থাৎ কর্কটক্রান্তি রেখা বরাবর নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। নিম্নচাপের কারণে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। আবার অনেক সময় উপক্রান্তীয় জেট বায়ু উত্তর দিকে সরে যাওয়ার হলে মৌসুমি বিস্ফোরণ হয়। কিন্তু তিব্বত মালভূমি উষ্ণতা বেশি না হলে ক্রান্তীয় জেড শক্তিশালী হতে পারে না, ফলে ঠিকমতো বৃষ্টিপাত হয় না। জেট বায়ু এভাবেই ভারতের জলবায়ুকে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করে। শীতকালে পশ্চিমা জেট বায়ু ভূমধ্যসাগর থেকে পশ্চিমী ঝঞ্ঝাকে ভারতে নিয়ে আসে এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতের বৃষ্টিপাত ঘটায়।


ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত এর প্রভাব:

ভারতীয় মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণে আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণবাত দক্ষিণ ভারতের জলবায়ুকে প্রভাবিত করে। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর আগমনের সময় (গ্রীষ্মকালে) এবং প্রত্যাবর্তনের সময় (শীতকালে) নিম্নচাপের সৃষ্টি হয় এবং এই নিম্নচাপ থেকে জন্ম নেয় ঘূর্ণবাত বা সাইক্লোন। এই সাইক্লোন এর প্রভাবে ভারতের উপকূল অঞ্চলে ঝড় বৃষ্টি হয়। আবার নিম্নচাপ গভীর হলে কখনো কখনো শক্তিশালী ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি হয়। ঘূর্ণবাতের কারণে কখনো কখনো উপকূল এবং উপকূল সংলগ্ন অঞ্চলে তাণ্ডব এবং ক্ষয়ক্ষতি হয়। যেমন: ২০২০ সালের আমফান ঘূর্ণিঝড়।


পশ্চিমী ঝঞ্জা:

আমার দেশের শীতকালে ভূমধ্যসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ভূমধ্যসাগর থেকে আসা পশ্চিমা বায়ু, দেশের উত্তর ও পশ্চিম প্রান্তে যে দুর্যোগের সৃষ্টি করে তা পশ্চিমী ঝঞ্জা নামে পরিচিত। পশ্চিমী ঝঞ্ঝার প্রভাবে আকাশ একটা নাম মেঘলা থাকে এবং হালকা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হয়। পশ্চিমী ঝঞ্জা তুষারপাত ঘটাতে সাহায্য করে এবং শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি করে।


এল নিনো:

এল নিনো আসলে প্রশান্ত মহাসাগরের পেরু এবং ইকুয়েডর উপকূল বরাবর প্রবাহিত দক্ষিণমুখী উষ্ণ স্রোত। এই উষ্ণ স্রোতের কারণে পেরু এবং ইকুয়েডর উপকূলে ঝড়-বৃষ্টি এবং দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়। কিন্তু ভারতে এর প্রভাব ঠিক উল্টো হয়। এল নিনোর প্রভাবে ভারতে মৌসুমী বায়ুর আগমন বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে মৌসুমী বায়ু দেরিতে ভারতে প্রবেশ করে এবং প্রয়োজনের তুলনায় কম বৃষ্টিপাত হয় এবং অনেক সময় খরার সৃষ্টি হয়


লা নিনা:

লা নিনা আসলে প্রশান্ত মহাসাগরের পেরু এবং ইকুয়েডর উপকূল বরাবর প্রবাহিত দক্ষিণমুখী শীতল সমুদ্র স্রোত। এই শীতল স্রোতের কারণে পেরু এবং ইকুয়েডর উপকূলে অনাবৃষ্টি, খরা এবং শীতে শৈত্যপ্রবাহ সৃষ্টি হয়। কিন্তু ভারতে এর প্রভাব ঠিক উল্টো হয়। লা নিনার প্রভাবে ভারতে মৌসুমী বায়ুর আগমন ত্বরান্বিত হয়। ফলে মৌসুমী বায়ু দ্রুত ভারতে প্রবেশ করে এবং প্রয়োজনের তুলনায় বেশি বৃষ্টিপাত হয়। এর ফলে অনেক সময় ভারতে বন্যা দেখা যায়।

Post a Comment

0 Comments